যুধিষ্ঠিরের সত্যনিষ্ঠা: দুর্বলতা না মহত্ত্ব?
- Arunava Khasnobis
- Aug 3
- 2 min read
যুধিষ্ঠিরের সত্যনিষ্ঠা: দুর্বলতা না মহত্ত্ব?
যুধিষ্ঠির—ধর্মপুত্র, সত্যনিষ্ঠ, শান্তস্বভাব। মহাভারতের প্রতিটি যুদ্ধে, প্রতিটি নৈতিক প্রশ্নে তিনি ছিলেন বিবেকের প্রতিনিধিত্বকারী। কিন্তু তাঁর এই সততার কারণে কি অনেক সময় পাণ্ডবদের দুর্বল হয়ে যেতে দেখা গেছে?তাঁর সত্যনিষ্ঠা কি আদৌ নেতৃত্বের গুণ ছিল, নাকি তা ছিল বাস্তবতাবিচ্ছিন্ন এক আত্মঘাতী মহত্ব?
এই লেখায় আমরা খুঁজব—যুধিষ্ঠিরের “ধর্ম” কী ছিল আসলে, এবং তার প্রভাব কেমন হয়েছিল কুরুক্ষেত্রের ঘটনাপ্রবাহে।
ধর্মপুত্র পরিচয়: সৌভাগ্য না দায়?
যুধিষ্ঠির জন্ম থেকেই ছিলেন “ধর্মরাজ”। কুন্তী মা একদিন মন্ত্র উচ্চারণ করে ধর্ম দেবতাকে আহ্বান করলে তিনি জন্মান। তাঁর মধ্যেই ধর্মের আদর্শিক প্রতিচ্ছবি বসে যায়—সততা, সংযম, ন্যায়বিচার।
এই পরিচয় তাঁকে মহৎ করেছে, আবার আটকে রেখেছে—কারণ:
তিনি সবসময় সত্য বলার চেষ্টা করেছেন—even যদি তার ফল বিপজ্জনক হয়
তিনি রাজনীতিতে অসহায় থেকেছেন, কৌশলে দুর্বল থেকেছেন
অনেক সময় দাদা হয়েও সিদ্ধান্তে দেরি করেছেন, দ্বিধায় থেকেছেন
👉 প্রশ্ন ওঠে—সত্যনিষ্ঠা যদি বাস্তব জ্ঞানহীন হয়, তবে তা কি মহত্ত্ব নাকি বোঝা?
পাশার খেলা: নৈতিকতা না নির্বোধতা?
মহাভারতের সবচেয়ে নৃশংস পর্ব—পাশার খেলা। দুর্যোধনের প্ররোচনায় যুধিষ্ঠির খেলায় বসেন।তিনি জানতেন—শকুনি একজন কৌশলী জুয়াড়ি। তবুও একের পর এক বাজি ধরেন—নিজের রাজ্য, ভাই, এমনকি দ্রৌপদীকেও।
কারণ?
রাজাকে আমন্ত্রণ করলে তিনি ফেরাতে পারেন না—এটাই তাঁর “ধর্ম”
খেলার মাঝখানে ছেড়ে ওঠা সম্মানহানিকর—এটাও তাঁর “ধর্ম”
👉 কিন্তু সেই “ধর্ম” কি ন্যায়ের রক্ষক, না আত্মহননের পথ?
যুদ্ধের সময় যুধিষ্ঠির: দৃঢ় না দ্বিধাগ্রস্ত?
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় যুধিষ্ঠির ছিলেন সেনাপতি না হলেও পাণ্ডবদের নেতৃত্বে। কিন্তু:
শত্রু নিধনে কোনো কৌশলপ্রধান সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায় না
অস্ত্রের চেয়ে আলোচনা ও শান্তির পথে তাঁর আকর্ষণ ছিল বেশি
কর্ণের মৃত্যু বা দ্রোণের দুর্বলতা নিয়ে তিনি মানসিকভাবে দ্বিধায় ভোগেন
👉 তাঁর সততা তখন অনেক সময় হয়ে দাঁড়ায় "গতি থামিয়ে দেওয়া এক ভারী চিন্তা"।
“অশ্বত্থামা হতো”—সত্য, না সুবিধাবাদ?
যুদ্ধের একটি কৌশল ছিল দ্রোণাচার্যকে দুর্বল করা।ভীম “অশ্বত্থামা হতো” বলে চিৎকার করে, যুধিষ্ঠির শেষের অংশ মৃদু স্বরে বলেন—“হাতি”।
যুধিষ্ঠির জীবনে প্রথম মিথ্যা বলেন, তাও আংশিক।এই ঘটনাই দেখিয়ে দেয়—যুদ্ধের বাস্তবতা ধর্মের সরলতা ভেঙে দেয়।
যুদ্ধশেষে তাঁর মানসিক অবস্থা: বিজয়ী না ক্লান্ত?
যুদ্ধ শেষে পাণ্ডবরা জয়ী হয়। কিন্তু যুধিষ্ঠির সে রাজ্য চান না। তিনি বলেন:
“আমাদের জয়ের জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারাল। এটা কোন বিজয়?”
তিনি রাজ্য ত্যাগ করেন, ভাইদের নিয়ে মহাপ্রস্থানের পথে বেরিয়ে পড়েন।
👉 নায়ক হলেও তিনি একজন ক্লান্ত, দগ্ধ মানুষ—যিনি রাজনীতি নয়, ন্যায় খুঁজছিলেন।
মহত্ত্ব নাকি এক ধরণের একাকীত্ব?
যুধিষ্ঠিরের সত্যনিষ্ঠা ছিল অনড়, অনমনীয়, কিন্তু যুগোপযোগী ছিল না সবসময়।তিনি ছিলেন এক নৈতিক দণ্ডায়মান পুরুষ, যিনি এক হাত দিয়ে ধর্মকে ধরেছেন, আর অন্য হাতে বাস্তবতাকে সরিয়ে রেখেছেন।
তাঁর মহত্ত্ব প্রশ্নাতীত, কিন্তু সেই মহত্ত্ব অন্ধ নয় তো?নাকি আমরা আজও যুধিষ্ঠিরের সেই নৈতিক লড়াই থেকে শিখি—সত্য কঠিন, কিন্তু পালানোর উপায় নয়।



Comments