ভীষ্ম প্রতিজ্ঞা: আত্মসংযমের মহাকাব্য না নীরব ধ্বংসের শৃঙ্খল?
- Arunava Khasnobis
- Aug 3
- 2 min read
ভীষ্ম। এক নাম নয়—এক প্রতীক। এক ব্যক্তিত্ব নয়—এক যুগের কণ্ঠরোধ। মহাভারতের এই আশ্চর্য চরিত্র যেন মানবসভ্যতার আত্মত্যাগ, নৈতিকতা আর শুদ্ধ আদর্শের প্রতিভূ, আবার একই সঙ্গে এক বেদনাময় নৈঃশব্দ্যের মূর্ত প্রতিচ্ছবি।

তিনি এমন এক ব্রত নিয়েছিলেন—যা ছিল দেবতাকেও বিস্মিত করে, আর মানবকে করে স্তব্ধ। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, সেই ব্রত কি কেবল ত্যাগের অমল স্বর্ণমুকুট? নাকি ছিল এক অন্ধ নিষ্ঠার, কঠোর অনমনীয়তার, এবং আত্মপরিচয় মুছে ফেলার নিষ্ঠুর শিলালিপি?
প্রেমহীন আত্মোৎসর্গের সূচনা: এক পিতার সুখে এক পুত্রের মৃত্যু
রাজা শান্তনুর হৃদয়ে উথলে ওঠা প্রেম, এবং সত্যবতীর পিতার এক জেদি শর্ত—এই দুইয়ের মাঝে দাঁড়িয়েছিলেন ভীষ্ম। একাধারে পুত্র, একাধারে রাজপুত্র, কিন্তু সবার উপরে একজন আদর্শবান যোদ্ধা। তিনি প্রেম করেননি, করেননি দাম্পত্যের দাবি; এক চিরকালীন ত্যাগে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন, যেন এক শুদ্ধ যজ্ঞে আত্মাহুতি দিয়েছেন।
এই মুহূর্তে ভীষ্ম একজন মানুষ ছিলেন না—তিনি এক ব্রত। এক প্রতিজ্ঞা। এমন একটি আত্মত্যাগ, যেখানে জীবন থেমে যায়, শুধু কর্তব্য বেঁচে থাকে।
নৈতিকতা না আত্মঅস্বীকৃতি: কারা পেল লাভ, কারা পেল ক্ষয়?
তাঁর প্রতিজ্ঞা রাজবংশকে দিল সাময়িক স্থিতি। কিন্তু সেই স্থিতি কি ছিল দীর্ঘস্থায়ী, না ছিল এক নীরব বিভাজনের সূচনা?
পরবর্তী প্রজন্ম রাজ্য চালনায় ব্যর্থ হয়। পাণ্ডব-কৌরব বিরোধ ক্রমে পরিণত হয় এক অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধজ্বালায়। ভীষ্ম—যিনি প্রতিনিয়ত সত্য-ধর্মের কথা বলতেন—নিজেই হয়ে ওঠেন ন্যায়ের সামনে দাঁড়ানো এক নীরব প্রহরী। দাঁড়িয়ে থাকেন দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার সামনে, পাশার খেলায় রাজধর্মের পতনের মুহূর্তে—কিন্তু বলেন না একটি শব্দও।
এমন নীরবতা কি শক্তি? না এক কঠিন প্রতিজ্ঞার মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাওয়া আত্মার বিলুপ্ত প্রতিধ্বনি?
নিয়তির শিকলে বাঁধা এক মহান পুরুষ
যখন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরু হয়, ভীষ্ম জানতেন—ধর্ম আছে পাণ্ডবদের পক্ষে। তবুও তিনি লড়েন কৌরবদের পক্ষে, কারণ তাঁর শপথ তাঁকে বলির বেদীতে বাধ্য করে।
এ যেন এক পুরুষ, যে নিজেরই রচিত নিয়তির ফাঁদে বন্দি। তাঁর জ্ঞান, শক্তি, উপলব্ধি—সবই বর্ণহীন, কারণ তিনি জীবনের কোনো সিদ্ধান্তে আর নিজস্বতা রাখতে পারেন না।
এমন আত্মসংযম, যেখানে মানুষ আর নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রক নয়—সে কি সত্যিই গৌরবের? নাকি এক করুণ আত্মপরিত্যাগ?
শরশয্যার নীরবতা: শেষ এক দীর্ঘশ্বাস
শয়ে শয়ে তির বিদ্ধ শরীরে শুয়ে থাকা ভীষ্ম, যুদ্ধের শেষে নয়, জীবনের শেষে নয়—শুয়ে আছেন এক নীরব বেদনায়। অপেক্ষায় আছেন মৃত্যুর, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি অনেক আগেই মরে গেছেন—সেই দিন, যেদিন তিনি নিজের জীবনকে অন্যের ইচ্ছার হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
তাঁর প্রতিজ্ঞা তাঁকে ভীষ্ম করেছে—কিন্তু মানুষ থেকে কেড়ে নিয়েছে মানুষের সহজাত স্পন্দন, সহজাত প্রতিবাদ, সহজাত ভালোবাসা।
উপসংহার: প্রতিজ্ঞার সৌন্দর্য, যদি তাতে প্রাণ থাকে
ভীষ্ম এক মহাবীর, এক নীতির মূর্ত প্রতীক। কিন্তু মহাভারতের ধ্বংসগাথা বলছে—যে নীতি মানুষকে জীবনের সংবেদনশীলতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে, তা একসময় মহৎ না থেকে হয়ে ওঠে ভয়ের। ব্রত যদি মানুষের কল্যাণে না লাগে, তবে সে হয়ে ওঠে নির্বাক পতনের যন্ত্র।
ভীষ্ম নিজেই ছিলেন এক যুদ্ধ—আত্মমর্যাদার সঙ্গে আত্মনাশের। এবং হয়তো তিনিই আমাদের শিখিয়ে গেছেন—নৈতিকতা যখন নমনীয় নয়, যখন তা অনুভূতির বিবেচনায় নিজেকে রূপান্তর করতে জানে না, তখন তা নিজের হাতে তৈরি করে এক নিঃসঙ্গ মৃত্যুশয্যা।



Comments